• রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪২৯

শিক্ষা

নয় বছরেরও নেই অগ্রগতি

  • ''
  • প্রকাশিত ২৪ মার্চ ২০২৪

তরিকুল ইসলাম সুমন:

আসছে বর্ষা, আর এই বর্ষাতেই ১০ থেকে ১৫ হাজার শিশু মারা যায় পানিতে যুবে যাদের অধিকাশেরই বয়স ১৮ বছরের নিচে। এ কারণে ২০১৫ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয় বিশেষ করে ছোট শিশু বা শিক্ষার্থীদের সাঁতার প্রশিক্ষাণের গুরুত্ব দিয়ে একটি পরিপত্র জারি করা হয়েছিল। কিন্তু পরিপত্র জারির প্রায় নয় বছর পার হলেও নেই কোনো কার্যক্রম। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে এ বিষয়ে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। নেই কোনো কার্যক্রমও। শুধুমাত্র পাঠ্যপুস্তকে কিছুটা সাঁতারবিষয়ক প্রবন্ধের মধ্য দিয়েই দায় সেরেছে এনসিটিবি।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ২০১৫ সালের এপ্রিল মাসে তৎকালীন শিক্ষাসচিব নজরুল ইসলাম খান স্বাক্ষরিত এক পরিপত্রে উচ্চ মাধ্যমিক, মাধ্যমিক ও নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়, সমমানের মাদরাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষা কার্যক্রমের অংশ হিসেবে সাঁতার প্রশিক্ষণ ও অনুশীলনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ অনুযায়ী ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত শারীরিক শিক্ষা, স্বাস্থ্য বিজ্ঞান ও খেলাধুলা পাঠ্য বিষয় হিসেবে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। সে পরিপ্রেক্ষিতে সাঁতারকে অন্যতম একটি ক্রীড়া হিসেবে গণ্য করার পাশাপাশি জীবন রক্ষাকারী কৌশল চর্চা হিসেবে দেখা হচ্ছে। ৫ থেকে ১৭ বছরের ছেলেমেয়েদের ওপর পরিচালিত ইউনিসেফের এক জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশে প্রতি ২৪ ঘণ্টায় ৪৮ জন এবং প্রতি বছরে প্রায় ১৮ হাজারের বেশি ছেলেমেয়ে সাঁতার না জানার কারণে ডুবে মারা যায়।

তাই সরকার এখন থেকে দেশের সব উচ্চ মাধ্যমিক, মাধ্যমিক ও নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়, সমমানের মাদরাসা, কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত শিক্ষা কার্যক্রমের অংশ হিসেবে সাঁতার প্রশিক্ষণ ও অনুশীলনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি নির্দেশনায় বলা হয়েছে, শিক্ষার্থী তথা আগামী প্রজন্মকে জীবন রক্ষাকারী কৌশল চর্চায় সক্ষমতা অর্জনে দেশের সকল উচ্চ মাধ্যমিক, মাধ্যমিক ও নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়, সমমানের মাদ্রাসা, কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সাঁতার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। জলাশয় স্বাস্থ্যসম্মত ও সাঁতার উপযোগী করবে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতর। সাঁতার প্রশিক্ষণ ও অনুশীলনের সময় সহকারী শিক্ষক (শারীরিক শিক্ষা) অথবা সাঁতার প্রশিক্ষকের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে। পরিপত্রে আরো বলা হয়েছিল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানরা সহকারী শিক্ষকের (শারীরিক শিক্ষা) সহায়তায় যথাযথ ব্যবস্থা নেবেন ও এ সংক্রান্ত মাসিক প্রতিবেদন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে (মহানগরীর ক্ষেত্রে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ও জেলা শিক্ষা অফিসারের কাছে) দাখিল করবেন। সব অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি), ইউএনও ও মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তাকে সাঁতার প্রশিক্ষণ ও চর্চার বিষয়টি তদারকি করার জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তারা ত্রৈমাসিক প্রতিবেদন মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) মহাপরিচালকের কাছে প্রতিবেদন করবেন বলেও পরিপত্রে বলা হয়েছে। মাউশি তিন মাস পর পর এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন পাঠাবে।

মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক অধিদপ্তরের (মাউশি) পরিচালক (কলেজ ও প্রশাসন উইং) অধ্যাপক মো. শাহেদুল খবির চৌধুরী বলেন, এ বিষয়ে তারা কিছু জানা নেই। তবে তাদের পাঠ্যপুস্তক ও শিক্ষা কারিকুলামে বিষয়টি রয়েছে। তবে শিক্ষার্থীদের সাঁতার শিখানোর বিষয়টি অনেক দুরহ। কারণ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেতো আর পুকুরসহ প্রশিক্ষণ উপযোগী অবকাঠামো নেই। এ কারণে প্রক্ষিণের বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট কার্যক্রম নেই। নির্দেশনা দিলেও নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে স্থানীয় পর্যায়ে এটি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না। এ পর্যন্ত মাউশিতে কোনো প্রতিবেদন জমা পরেছে বলেও তিনি জানান না।

প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পলিসি এবং অপারেশন বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, শিশুদের সাঁতারের বিষয়টি পাঠ্যপুস্তকে থাকলেও বাস্তবে এর কোনো প্রয়োগ নেই। নেই কোনো প্রকল্পও। ফলে পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যু রোধে কোনোই অবদান রাখতে পারছেন প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর।

২০২২ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ৫ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে যারা পানিতে ডুবে মারা যায় তাদের ৮০ শতাংশই বসত ঘর থেকে ২০ মিটার দূরত্বের মধ্যে কোনো পুকুর-জলাশয়ে দুর্ঘটনায় পড়ে। বাংলাদেশে একাধিক শিশু, বিশেষভাবে যমজ শিশুদের একই স্থানে একই সঙ্গে পানিতে ডুবে মারা যেতে দেখা যায়। সাধারণত একটি শিশু অন্য শিশুকে পানিতে ডুবে মারা যাওয়ার সময় বাঁচাতে গিয়ে একসঙ্গে মারা যায়। এতে বোঝা যায়, শিশুকে পানি থেকে নিরাপত্তা কৌশল, বিশেষত নিরাপদ উদ্ধার কৌশল সম্পর্কে সঠিকভাবে শিক্ষা দেওয়া হয় না।

শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা জানান, সচেতনতার অভাব, বয়স্কদের দ্বারা শিশু তত্ত্বাবধানের অভাব এবং অবহেলাকে পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে গণ্য করা হয়। অনেক সময় শিশুদের নিরাপদ মনে হলেও বাস্তবতা ভিন্ন হয়। যেমন অনেকে মনে করেন, তাদের শিশু পানিতে ডুবে মারা যাবে না, কারণ তারা অত্যন্ত ভালো পিতা-মাতা। কিন্তু, বাস্তবতা হচ্ছে, শিশু পানিতে ডুবে মারা যাওয়ার আগে এমন চিন্তাই করেন মা বাবারা। কেউই ভাবেন না যে তাদের শিশু পানিতে ডুবে মারা যেতে পারে। সঠিক তত্ত্বাবধান ছাড়া কোনো শিশুই পানি থেকে নিরাপদ নয়। অনেকে তাদের ছোট সন্তানকে বড় সন্তানের তত্ত্বাবধানে রেখে নিশ্চিন্ত অনুভব করেন। কিন্তু, এমন সময়েও অনেক শিশু মারা যেতে দেখা যায়। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের অনেক মানুষের বসত বাড়িতেও শিশুদেরকে পুকুরের পানিতে ডুবে মারা যেতে দেখা যায়।

শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন ও অর্থ) ড. অমিতাভ চক্রবর্তী বলেন, শিশুদের বা শিক্ষার্থীদের সাঁতার শেখানোর জন্য সুস্পষ্ট কোনো উদ্যোগ নেই। তবে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পুকুর, দীঘি বা জলাধার সংস্থারের প্রয়োজন হলে তা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ও অর্থ প্রাপ্তি সাপেক্ষে করে দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। তবে এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে আবেদন করতে হবে।

এনসিটিবির শিক্ষক প্রশিক্ষণ ও অ্যাসেসমেন্ট শাখার বিশষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শিক্ষক প্রশিক্ষণ ও অ্যাসেসমেন্টের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের সাঁতার প্রশিক্ষণের কোনো বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। এ বিষয়ে কোনো কর্মকর্তা কেমন কিছু জানেনও না।

শিক্ষাবিদদের সঙ্গে কথা বলে জানাগেছে, বিশ্বের অনেক দেশই উচ্চতর ডিগ্রির ক্ষেত্রে সাঁতারকে গুরুত্ব দিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে সাঁতার শেখার ব্যপক সুযোগ সুবিধা থাকার পরেও প্রতি বছর গড়ে ১৭-১৮ হাজার শিশু কিশোর মারা যায় যাদের দয়স ১৮ বছরের নিচে। শুনেছি একটি শিক্ষা মন্ত্রণালয় বেশ কয়েক বছর আগে সাঁতার শেখানোকে গুরুত্বদিয়ে একটি পরিপত্রও জারি করেছিল। কিন্তু তা বাস্তবায়নের ছিঁটে ফোঁটাও চোখে পরছে না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শারীরিক শিক্ষার শিক্ষক থাকলেও তারা সাঁতার প্রশিক্ষণ বা এ বিষয়ে গুরুত্ব দিচ্ছে না। এটি যে একটি জীবন রক্ষাকারী দক্ষতা, শরীরচর্চার অংশ হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে। স্কুল যদি পুরো জীবনকে এমনভাবে গড়ে দেওয়ার অংশ হয়ে থাকে, যাতে সে সমাজের সঙ্গে সুস্থতা বজায় রেখে চলতে পারে, তাহলে শিক্ষায় মনের স্বাস্থ্যের পাশাপাশি শরীরের স্বাস্থ্যের ব্যাপারে জোর দেওয়া আবশ্যিক।

পানিতে ডুবে মারা যাওয়া শিশুদের রক্ষায় ৪৫ উপজেলায় তিন লাখ ৬০ হাজার শিশুকে সাঁতার প্রশিক্ষণ দেবে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়। পানিতে ডুবে যাওয়া রোধে সরকার এই প্রথম দেশে সরকারিভাবে পোর্টেবল সুইমিং পুলে সাঁতার প্রশিক্ষণ দেয়ার ব্যবস্থা করেছে। এর ফলে শহরের শিশুরা সহজেই পোর্টেবল সুইমিং পুলে সাঁতার শিখানোর কার্যক্রম পরিচালনা করছে। শিশুর জীবন সুরক্ষায় সাঁতার প্রশিক্ষণ কর্মসূচির মাধ্যমে শিশুকে সাঁতার প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। ‘সমন্বিত শিশু যত্ন কেন্দ্রের মাধ্যমে শিশুদের প্রারম্ভিক বিকাশ ও সুরক্ষা, উন্নয়ন ও শিশুর সাঁতার প্রশিক্ষণ’ প্রকল্প থেকে ১৬টি জেলায় ৪৫টি উপজেলার শিশুকে সাঁতার প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।

এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক ও মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় যুগ্ম সচিব মোসা. ফেরদৌসি বেগম বলেন, দেশের ১৬টি জেলায় ৪৫টি উপজেলায় এ কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। তবে শিশুদের পানিতে ডুবে মৃত্যুর সংখ্যা কতোটা কমাতে পারবে সেটা বলা মুশকিল। আর একটা প্রকল্প দিয়ে কতটুকুই সম্ভব হবে সেটা নিশ্চিত করে বলা যাবে না। তবে আমরা চেষ্টা করছি। পানিতে যুবে যাওয়া রোধে কিছুটা হলেও সুবিধা আসবে বলে তিনি মনে করেন। শিশুর প্রারম্ভিক বিকাশ, সুরক্ষা ও সাঁতার সুবিধা দেওয়ার লক্ষ্যে একটি প্রকল্প গ্রহণ করেছে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়।

বাংলাদেশ জাতীয় সাঁতার দলের সাবেক কোচ আলমগীর হোসেন বলেন, প্রতিবছর ৩০ হাজার শিশু-কিশোর পানিতে ডুবে মারা যায়। দেশের ৮০ শতাংশ শিশুই সাঁতার জানে না। আমাদের পদক্ষেপে সরকার প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে সাঁতার শেখা বাধ্যতামূলক করেছে। তবে স্কুলগুলোতে এখনো এটা চালু হয়নি। এটি চালু হলে অন্তত ৮০ শতাংশ শিশুর জীবন বাঁচানো যেত। আমাদের পদক্ষেপে সরকার প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে সাঁতার শেখা বাধ্যতামূলক করেছে। তবে স্কুলগুলোতে এখনো এটা চালু হয়নি। এটি চালু হলে অন্তত ৮০ শতাংশ শিশুর জীবন বাঁচানো যেত।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads